খাজা খায়ের সুজনঃ
১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি পেশ করেন। এই দাবি পেশ করার শুরুটা ছিল এইরকম- “আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবি রূপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি।“ [আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা কর্মসূচি, কারাগারের রোজনামচা, পাতা-৩০৯]
১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির সমর্থনে আওয়ামীলীগের আহ্বানে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট চলাকালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মদতে পুলিশের গুলিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ১১ জন ব্যক্তি নিহত হন। আহত ও গ্রেপ্তার হন অনেকে। এই ৬ দফা দাবি নিয়ে জনগণের অধিকারের কথা বলার কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম,যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন শহরে ৮ বার গ্রেপ্তার হন ও জামিন পান। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ থেকে মিটিং করে আসার সময় তিনি গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য দাবি তুলে ধরেছেন তখনই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করেছে সরকার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বঙ্গবন্ধু যতগুলি রাজনৈতিক ও সামাজিক এজেন্ডা হাতে নিয়েছিলেন তার মধ্যে ৬-দফাই আমাদের কে সরাসরি স্বাধীনতার দিকে খুব দ্রুত সময়ে ধাবিত করে।
পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর জেঁকে বসা উপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও নির্যাতনের শিকার বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ৬ দফা দাবি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত এই ৬ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন-সংগ্রামই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয় এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের পথ রচনা করে। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতারা তাসখন্দ-উত্তর রাজনীতির গতিধারা নিরূপণের উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে তিনি এই ছয়দফা পেশ করেন। সংক্ষেপে ৬ দফার দাবিসমূহ হচ্ছে-
১। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনে পরিণত করতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত আইন পরিষদ সার্বভৌম হবে;
২। ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে শুধু দুটি বিষয়, প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক, এবং অপর সব বিষয় ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত রাজ্যসমূহের হাতে ন্যস্ত থাকবে;
৩। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু করতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটিই মুদ্রা ব্যবস্থা থাকবে, একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও দুটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। তবে এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পুঁজি যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে তার ব্যবস্থা সম্বলিত সুনির্দিষ্ট বিধি সংবিধানে সন্নিবিষ্ট করতে হবে;
৪। দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক হিসাব থাকবে এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা রাজ্যের হাতে থাকবে। তবে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে কিংবা উভয়ের স্বীকৃত অন্য কোনো হারে আদায় করা হবে;
৫। দুই অংশের মধ্যে দেশিয় পণ্য বিনিময়ে কোনো শুল্ক ধার্য করা হবে না এবং রাজ্যগুলো যাতে যেকোন বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে।
৬। প্রতিরক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে আধা-সামরিক রক্ষীবাহিনী গঠন, পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা স্থাপন এবং কেন্দ্রীয় নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু সাবজেক্ট কমিটির সভায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি হিসেবে ‘ছয়দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন এবং তা সম্মেলনের আলোচ্য সূচির অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। কিন্তু সম্মেলনের উদ্যোক্তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রপত্রিকায় ছয়দফার বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী রূপে চিত্রিত করা হয়। তাঁদের মোদ্দা কথা ছিল, শেখ মুজিব পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছেন। এরফলে তিনি ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন।
১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা সম্বলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়।
এরপর পরই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ ছয়দফা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া শুরু করেন। বঙ্গবন্ধু দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন। তাঁর এই অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে খুবই স্বল্প সময়ে ছয়দফা বাঙ্গালীর প্রাণের দাবি রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ছয়দফা কে ঘিরে বাঙ্গালীর নতুন স্বপ্ন শুরু হয়। ছয়দফা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে খুব দ্রুত সময়ে। এই প্রসঙ্গে তৎকালীন সময়ে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁর ইত্তেফাকের ‘রাজনৈতিক মঞ্চে’ লিখেছিলেন ‘৬ দফা প্রস্তাবের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ অবশ্য কোন ব্যক্তি এমনকি কোন দলবিশেষ নয়। আজ দেশবাসীর সম্মুখে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে, ৬ দফার সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রামের মধ্যেই সেই বাঁচা-মরার সমস্যার সমাধানের পথ নিহিত রহিয়াছে, ইহাই সর্বশ্রেণীর জনগণের বিশ্বাস।’ [ইত্তেফাক, ২৭ মার্চ ১৯৬৬]
৬ দফা যে এই বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ তা বুঝতে এ দেশের মানুষ একটুও ভুল করেনি। তাই আমাদের মহান নেতা বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ৬ দফাই হয়ে ওঠে বাঙালির স্বাধীনতার মুল সোপান। ৬ দফা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতার পথ রচনা ছিল অসম্ভব।
এই প্রসঙ্গে তৎকালীন ডাকসু ভিপি মাহফুজা খানম বলেন, ‘১৯৬৬ সাল বছরটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কারণ এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে এক সম্মেলনে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এর কিছুদিন পর ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ৬ দফাকে বাঙ্গালীর বাঁচার দাবি হিসেবে আবার ও শেখ মুজিবুর রহমান পেশ করেন এবং দলীয় কর্মসূচী আকারে গ্রহণ করেন।’ [মাহফুজা খানম, ছাত্র রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ আগে ও পরে, পাতা-৫৪] মাহফুজা খানমের এই উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, কেননা তিনি তৎকালীন সময়ে ছাত্র ইউনিয়ন এর প্যানেল থেকে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাত্রলীগ প্যানেল কে হারিয়ে। তাঁর সময়ে ৬ দফার জন্য ডাকসু ও অনেক কর্মসূচি পালন করে, এর মাধ্যমে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, ছয় দফা দলমত নির্বিশেষে সবার বাঁচার দাবি হিসেবে সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।
এই ছয় দফার বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কর্মসূচি নিয়ে। যখনই তিনি ছয় দফার পক্ষে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণের বিপক্ষে বক্তৃতা দিয়েছেন তখনই তিনি গ্রেফতার হয়েছেন । এই ছয়দফা বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগের উপর নেমে এসেছিল সবচেয়ে বেশি জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতন। ছয় দফা দাবি বাঙ্গালীদের মধ্যে যত প্রকট হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচার আরো প্রকট হতে থাকে। তাদের জেল জুলুম নির্যাতন আরো বেড়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধু এই ছয় দফার জন্য কি পরিমাণ নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছিলেন তা অনুধাবন করা যায় তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’র মাধ্যমে। সেখানে তাঁর তৎকালীন জেল জীবনের কথা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।
এই ছয় দফার সময়ে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জেলে থাকাবস্থায় তৎকালীন পাকিস্তান এর আইয়ুব-মোনায়েম সরকার ১৯৬৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে এক নম্বর আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৮ই জানুয়ারি ঢাকা কেন্দীয় কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার করে তাঁকে ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তায় বন্দি করে রাখে। এই প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘ছয় দফা না দিলে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলের নেতাদের ওপর নির্যাতন নেমে আসত না। সরকার আগরতলা মামলাও হয়তো ফেঁদে বসত না। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ম্যান্ডেটও ও রকম হতো না। তার পরের ইতিহাস সকলেরই জানা।’ [সৈয়দ আবুল মকসুদ: প্রথম আলো ০৭ জুন, ২০১৬] ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি জনগণের অব্যাহত প্রবল আন্দোলন সংগ্রাম ও চাপের মুখে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু সহ অন্য আসামিদের মুক্তিদানে বাধ্য হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয়দফা কর্মসূচির স্বপক্ষে গণরায়ের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। এ নির্বাচনে শেখ মুজিব ছয়দফার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সামনে আসে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সকলের জানা।
এই ছয়দফা শুধুমাত্র আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম কে বেগবান করেনি, ৬ দফা বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণারও উৎস। ছয়দফা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার। যার মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের নিরযাতিত-নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর। বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত মানুষের নেতা। বিশ্বের মানচিত্রে উঠে এসেছে একটি নতুন দেশ ‘বাংলাদেশ’।
লেখকঃছাত্রলীগ নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী